আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই, বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে। এ কৃপা কঠোর সঞ্চিত মোর জীবন ভ'রে। না চাহিতে মোরে যা করেছ দান আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ, দিনে দিনে তুমি নিতেছ আমায় সে মহাদানেরই যোগ্য করে অতি-ইচ্ছার সংকট হতে বাঁচায়ে মোরে। আমি কখনো-বা ভুলি, কখনো-বা চলি তোমার পথের লক্ষ্য ধরে; তুমি নিষ্ঠুর সম্মুখ হতে যাও সে সরে। এ যে তব দয়া জানি জানি হায়, নিতে চাও বলে ফিরাও আমায়, পূর্ণ করিয়া লবে এ জীবন তব মিলনেরই যোগ্য করে আধা-ইচ্ছার সংকট হতে বাঁচায়ে মোরে।
কাঁকনজোড়া এনে দিলেম যবে ভেবেছিলেম হয়তো খুশি হবে। তুলে তুমি নিলে হাতের 'পরে, ঘুরিয়ে তুমি দেখলে ক্ষণেক-তরে, পরেছিলে হয়তো গিয়ে ঘরে, হয়তো বা তা রেখেছিলে খুলে। এলে যেদিন বিদায় নেবার রাতে কাঁকন-দুটি দেখি নাই তো হাতে, হয়তো এলে ভুলে। দেয় যে জনা কী দশা পায় তাকে। দেওয়ার কথা কেনই মনে রাখে। পাকা যে ফল পড়ল মাটির টানে শাখা আবার চায় কি তাহার পানে। বাতাসেতে উড়িয়ে-দেওয়া গানে তারে কি আর স্মরণ করে পাখি। দিতে যারা জানে এ সংসারে এমন করেই তারা দিতে পারে কিছু না রয় বাকি। নিতে যারা জানে তারাই জানে, বোঝে তারা মূল্যটি কোন্খানে। তারাই জানে বুকের রত্নহারে সেই মণিটি কজন দিতে পারে হৃদয় দিয়ে দেখিতে হয় যারে -- যে পায় তারে পায় সে অবহেলে। পাওয়ার মতন পাওয়া যারে কহে সহজ বলেই সহজ তাহা নহে, দৈবে তারে মেলে। ভাবি যখন ভেবে না পাই তবে দেবার মতো কী আছে এই ভবে। কোন্ খনিতে কোন্ ধনভাণ্ডারে সাগরতলে কিম্বা সাগরপারে যক্ষরাজের লক্ষমণির হারে যা আছে তা কিছুই তো নয় প্রিয়ে! তাই তো বলি যা কিছু মোর দান গ্রহণ করেই করবে মূল্যবান আপন হৃদয় দিয়ে।
অনেককালের একটিমাত্র দিন কেমন করে বাঁধা পড়েছিল একটা কোনো ছন্দে, কোনো গানে, কোনো ছবিতে। কালের দূত তাকে সরিয়ে রেখেছিল চলাচলের পথের বাইরে। যুগের ভাসান খেলায় অনেক কিছু চলে গেল ঘাট পেরিয়ে, সে কখন ঠেকে গিয়েছিল বাঁকের মুখে কেউ জানতে পারে নি। মাঘের বনে আমের কত বোল ধরল, কত পড়ল ঝরে; ফাল্গুনে ফুটল পলাশ, গাছতলার মাটি দিল ছেয়ে; চৈত্রের রৌদ্রে আর সর্ষের খেতে কবির লড়াই লাগল যেন মাঠে আর আকাশে। আমার সেই আটকে-পড়া দিনটির গায়ে কোনো ঋতুর কোনো তুলির চিহ্ন লাগেনি। একদা ছিলেম ঐ দিনের মাঝখানেই। দিনটা ছিল গা ছড়িয়ে নানা কিছুর মধ্যে; তারা সমস্তই ঘেঁষে ছিল আশেপাশে সামনে। তাদের দেখে গেছি সবটাই কিন্তু চোখে পড়েনি সমস্তটা। ভালোবেসেছি, ভালো করে জানিনি কতখানি বেসেছি। অনেক গেছে ফেলাছড়া; আনমনার রসের পেয়ালায় বাকি ছিল কত। সেদিনের যে পরিচয় ছিল আমার মনে আজ দেখি তার চেহারা অন্য ছাঁদের। কত এলোমেলো, কত যেমন-তেমন সব গেছে মিলিয়ে। তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে পড়েছে যে তাকে আজ দূরের পটে দেখছি যেন সেদিনকার সে নববধূ। তনু তার দেহলতা, ধূপছায়া রঙের আঁচলটি মাথায় উঠেছে খোঁপাটুকু ছাড়িয়ে। ঠিকমতো সময়টি পাই নি। তাকে সব কথা বলবার, অনেক কথা বলা হয়েছে যখন-তখন, সে-সব বৃথা কথা। হতে হতে বেলা গেছে চলে। আজ দেখা দিয়েছে তার মূর্তি,-- স্তব্ধ সে দাঁড়িয়ে আছে ছায়া-আলোর বেড়ার মধ্যে, মনে হচ্ছে কী একটা কথা বলবে, বলা হল না,-- ইচ্ছে করছে ফিরে যাই পাশে, ফেরার পথ নেই।